adsence

Monday, July 18, 2016

অকালের সন্ধানে

হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ গুলোর ম্যাসেজ ডিলিট করতে করতে সেদিন হঠাৎ করেই একটা ম্যাসেজে চোখ আটকে গেল। অবশ্য বলা ভালো, ভাগ্যিস আটকে গেল! মহারাষ্ট্রের এক ভদ্রলোক, এই ৪৮ডিগ্রিতে, আহমেদনগর থেকে নানদেদ ট্রেন যাত্রার অভিজ্ঞতা লিখেছেন।
বাইরের তীব্র দাবদাহ আর জানলার শুষ্ক, গরম বাতাসের জন্যই সেদিন বোধহয় ৯ ঘণ্টার ট্রেন জার্নিতে স্লিপারটা বেশ ফাঁকাই ছিল । যত্নের অভাবে কম্পার্টমেন্টের একমাত্র মোবাইল চার্জিং পয়েন্টটা খারাপ। আর চাহিদার অভাবে ট্রেনের একমাত্র প্যান্ট্রি কার'টাও বন্ধ। তাই তৃষ্ণা মেটাতে সম্বল হাফ বোতলের গরম জলের কয়েকটা ফোঁটা। আর সময় কাটাতে ভরসা ব্যাগে গোঁজা মারাঠি একটা খবরের কাগজ। দুদিকের জানলায় দিগন্ত বিস্তৃত শুকিয়ে কাঠ বিঘা বিঘা ক্ষেতের সাথে বেশ সামঞ্জস্য রেখেছে সংবাদ শিরোনামটা। "দেশের প্রতি ১০টা আত্মহত্যার ৭ জনই কৃষক"। গত পাঁচ বছরে ভয়ঙ্কর খরা কবলিত এই মহারাষ্ট্রের মারাঠওয়াড়া আর বিদর্ভের কৃষকদের দুর্দশার কথা ভাবতে ভাবতেই ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। জানলার বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল একদল বৃদ্ধ-মহিলা-শিশু হাতে বালতি আর বোতল নিয়ে ট্রেনের দিকে ছুটে আসছে। ট্রেনে উঠেই ঐ দলের মহিলার প্রায় নি:সঙ্কোচেই ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের টয়লেটে গিয়ে ট্যাপ খুলে বালতিতে জল ধরতে লাগলো। অন্যদিকে শিশুরা হামাগুড়ি দিয়ে সিটের নিচে আর বয়স্করা উঁকি মেরে আপার বার্থে যাত্রীদের উচ্ছিষ্ট জলের বোতলে অবশিষ্ট এক-দু ফোঁটা জলের খোঁজ শুরু করলো। সবকিছুই চোখের সামনে এত তাড়াতাড়ি আর নিখুঁত ভাবে ঘটছিল যেন সবকিছুই 'ভেরি ওয়েল প্ল্যান্ড'। এক বৃদ্ধের কোলে বাচ্চা একটা মেয়ে। এক সহযাত্রী মেয়েটির হাতে তাঁর জলের বোতলের অবশিষ্ট টুকু তুলে দিতেই, বৃদ্ধ করজোড়ে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। জলের বোতল পেয়ে যখন বাচ্চা মেয়েটার মুখে একগাল হাসির সোনা ঝরছে ঠিক তখনই সম্বিত ফিরল আহাম্মক রেল পুলিশটার বাঁশিতে। লোকগুলো সবাই ভয়ে হুটোপুটি করে ট্রেন থেকে ঝাঁপ মারল ঠিকই, কিন্তু নিপুণ কৌশলে, ভরা জলের একফোঁটাও কিন্তু মাটিতে পড়ল না। টি.টি.ই এসে রেল পুলিশটাকে ক্ষান্ত করে বললেন, "এটাই এখন ওদের ডেলি রুটিন। গ্রামের পুরুষরা আগের স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে ওঠে। সময়, সুযোগ বুঝে চেন টেনে গাড়ি থামায়। ট্রেন থামলে এঁরা ট্রেনে উঠে এইভাবেই 'জল চুরি' করে। আর সেই জলেই কোনক্রমে আরও একদিন খরার সাথে লড়াই করে মরতে মরতে বেঁচে থাকে।"
পূর্ব মহারাষ্ট্রের লাতুর জেলায় প্রতিদিন প্রায় ৫ কোটি লিটার জল লাগে। কিন্তু জলের একমাত্র উৎস মানজার ড্যাম গত তিনমাস ধরে জলশূন্য। বিভিন্ন গাঁয়ের জমিদার আর সুদখোর মহাজনরা নিজেদের প্রয়োজনীয় জলটুকু বাঁচিয়ে কুয়ো গুলো চড়া দামে ভাড়া দিচ্ছেন প্রাইভেট কোম্পানিকে। নতুন লোগোর ঝাঁ চকচকে মোড়কে ১০০০ লিটার সেই জল বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকার বিনিময়ে। আসলে কারও সর্বনাশ হলে পরেই তো কারও পৌষ মাস হবে। তাই না? আর সুইজারল্যান্ডের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি নেসলে'র সিইও পিটার বার্বেক শুধু মুখেই বলেছিলেন "জল মানুষের মৌলিক অধিকার নয়। তাই জলের বেসরকারিকরণ হওয়া উচিত।" আমাদের লাতুর কিন্তু করে দেখাচ্ছে। সত্যি তো,  "मेरा देश बदल रहा है…आगे बढ़ रहा है"   
অবশ্য সবাই যদি বিদর্ভের দলিত শ্রমিক বাপুরাও তাজনের হতেন তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই যেতো। 'উচ্চবর্ণ'র দুয়ারে জল আনতে গিয়ে, অপমানিত, লাঞ্ছিত স্ত্রী'র চোখের জল মুছতে টানা ৪০ দিন, ৬ ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমে তাজনে আস্ত একটা কুয়ো কেটেই তাঁর প্রেম প্রতিজ্ঞার তৃষ্ণা মিটিয়েছেন। দলিত ঘরের সব  বৌ'দেরও 'স্বামী ভাগ্য'ও আবার তাজনের মত নয়। আর তাই থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন জানিয়েছে মহারাষ্ট্রের অনেক দলিত ঘরের বৌ'রা নাকি পানীয় জল জোগাড় করতে আজকাল বেশ্যা বৃত্তি'ও করছেন। 
এই মুহূর্তে খরা কবলিত দেশের ৩৩ কোটি মানুষ। অবশ্য এটা সেই সরকারী হিসেব যেটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বীরেন্দ্র চৌধুরী সংসদে পেশ করার সময় লোকসভা কক্ষে উপস্থিত ছিলেন ১০০'রও কম 'মাননীয়' সাংসদ। বেসরকারি হিসেব বলছে দেশে খরা কবলিত মানুষের সংখ্যা অন্তত ৫৪ কোটি। অর্থাৎ প্রতি ৫ জনে ২ জন। দেশের ৯১টি জলাধারের সঞ্চয় আজ এই দশকের সর্বনিম্ন, মাত্র ২৯%।  সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকার কে জানিয়েছে "২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে খরা কবলিত এলাকা সহ ১০০ দিনের কাজে বকেয়া মজুরি মোট ১২,০০০ কোটি টাকা। এটা কোন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নমুনা হতে পারে না।" সত্যি? পারে না? তবে যে শুনলাম শেষ ফিসক্যাল ইয়ারে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার নাকি 'দুনিয়া কাঁপানো' ৭.৯%? তাহলে কি দেশের এই শ্রী-বৃদ্ধি তে বকেয়া মজুরির হিসেব হয় না? টয়লেটের জলে রান্না-বান্নার 'পুষ্টি গুনের' হিসেব হয় না? লাতুরের গ্রামের মহাজন'দের জল ব্যবসার চড়া সুদের হিসেব হয় না? বাপুরাও তাজনের 'কান্না ঘাম রক্তের' হিসেব হয় না? দলিত বৌ'দের শরীরের দামের হিসেব হয় না? শুধু কি তাহলে সরকারের ২ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে 'পানাম স্ক্যাম' খ্যাত বিগ বি'র ভাড়া, ১০০০ কোটির কসমেটিক বিজ্ঞাপন আর প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণেই দেশের জিডিপি'র পার ক্যাপিটা' তরতরিয়ে চড়কে চাপে?
বুন্দেলখন্ডের খরা কবলিত একটি প্রত্যন্ত গ্রামের গ্রামসভাতে, তৃষ্ণার্ত একটি গরুর মৃত্যু কাহিনীর বর্ণনা শেষে, ক্লাস ফোরের মেয়েটা চোস্ত হিন্দিতে বলল "और उसके बात बो तड़प, तड़प के मोर गई..." খোঁজখবর  নিয়ে দেখা গেল, সত্যিই,  বুন্দেলখন্ডের ১৩টি জেলার প্রায় ১১,০৬৫ গ্রামে, শুধু গত মে মাসেই, জলের অভাবে মৃত্যু হয়েছে যে ৩ লক্ষ গবাদি পশুর তার বেশির ভাগটাই গরু। কিন্তু দেখুন এই 'গো-হত্যা' নিয়ে সঙ্গীত সোম'দের কোন মাথা ব্যথা নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর গলায় 'পিঙ্ক রিভলিউশেনের' হম্বিতম্বি নেই। এই গরুরা বোধহয় 'গোমাতা' নয়। এই গরুর মাংস খেতে বোধহয় কোন আপত্তি থাকবে না। এই 'গোমাতা' আখলাখ'দের ফ্রিজে থাকলেও তাঁদের বোধহয় মরতে হবে না। কারণ সব গোমাতা তো আর রাজনৈতিক পশু হয় না। সব 'গোমাতা' তো আর বিধানসভায় ভোট দেয় না

No comments:

Post a Comment

About Me

auto

my ad

64

65

61

60

69